আনন্দবাজার জেলা
উত্তর ও দক্ষিণ ২৪ পরগনা
দেশি ধানের ফলনে খুশি চাষিরাশান্তশ্রী মজুমদার
সাগর, ২৮ নভেম্বর, ২০১৫, ০১:১৯:১৯
উচ্চফলনশীল ধানচাষের দাপটে হারিয়ে গিয়েছিল অনেক দেশি ধানের বীজ, সেই সব পুরনো প্রজাতির ধান আবার ফিরে আসছে। জমিতে জৈব সার প্রয়োগ করে দেশি ধানের চাষে লাভের মুখও দেখতে পাচ্ছেন কৃষকরা। সাগর দ্বীপের বিভিন্ন এলাকায় এখন জনপ্রিয় হয়ে উঠছে কেরালাসুন্দরী, ভালুকী, কালাভাতের মতো প্রজাতির ধান চাষ। তবে ব্যবসায়িক ভিত্তিতে এই ধান চাষ এখনও শুরু করা যায়নি।
গঙ্গাসাগরের চাষি গোপাল গিরি তাঁর দেড় বিঘে জমিতে এবার ‘বহুরূপী’ ধানের চাষ করেছেন। তাঁর কথায়, ‘‘কোনও রকম সার ছাড়াই ফলন খুবই ভাল হয়েছে। ধান বুনতে খরচ কমেছে।’’ কৃষকরা জানিয়েছেন, এখন দেশি প্রজাতির ধান বিঘে প্রতি বুনতে খরচ পড়ছে প্রায় সাড়ে তিন হাজার টাকা। উচ্চফলনশীল ধানের চেয়েও বিঘে প্রতি বেশি ধান পেয়েছেন কোনও কোনও কৃষক। গঙ্গাসাগর-লাগোয়া সুমতিনগর, ধ্বসপাড়া, মৃত্যুঞ্জয়নগরের মতো এলাকাগুলিতেও দেশি প্রজাতির আমন চাষ বেড়েছে।
সুমতিনগর গ্রামের চাষি কমলাকান্ত মন্ডলের কথায়, ‘‘উচ্চফলনশীল ধান চাষে যেখানে ১ বিঘে জমিতে বুনতে ৬/৭ কিলো বীজ প্রয়োজন হত, দেশীয় বীজ প্রায় ১ কিলোতেই কাজ হচ্ছে। সঙ্গে শ্রমিকের খরচ এবং সার, কীটনাশকের খরচও কমেছে।’’ কমলাকান্তবাবু গত কয়েক বছর থেকে খইল এবং গোবর সার প্রয়োগ করে দেশি ধান চাষ করছেন। এবার তাঁর ২২ বিঘে জমিতেই গেলিগেটি, মৎস্যকণ্ঠা এবং ভালুকী ধানের চাষ করেছেন। ফলনও ভাল হয়েছে বলে তাঁর দাবি।
পাশেই মৃত্যুঞ্জয়নগরের প্রাক্তন শিক্ষকও নিজের জমিতে বরুরূপীর চাষ করেছিলেন। তাঁর কথায়, ‘‘ভাল মানের চাল স্বাস্থ্যকর। রাসায়নিক সার না দিয়ে, গত কয়েক বছরে জৈব সার প্রয়োগ করেই চাষ করছি।’’ দেশি ধানের মধ্যে কেরালাসুন্দরীর মতো কয়েকটি প্রজাতি নোনা জলের সংস্পর্শে এসেও টিকে থাকছে, দাবি করছেন কৃষকেরা। তাই সাগরের বিভিন্ন এলাকায় এর চাষ বাড়ছে।
এলাকায় বেশ কিছু স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা দেশি ধান চাষের প্রচলন বাড়ানোর চেষ্টা করছে। এ রকম এক সংস্থার কর্তা হিমাংশু মণ্ডলের সঙ্গে কথা বলে জানা গেল, তাঁরা নদিয়ায় কৃষি প্রশিক্ষণ কেন্দ্র এবং বিধানচন্দ্র কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে নানা প্রজাতির দেশি ধান সংগ্রহ করে নিয়ে আসছেন। তার থেকে বীজ তৈরি করে তা কৃষকদের মধ্যে বিলি করছেন। হিমাংশুবাবুর কথায়, ‘‘দুই-তিন দশকে ক্রমাগত প্রচুর সার এবং কীটনাশক দিয়ে জমির উর্বরতা কমে যাচ্ছে। তাই ২০১২ সাল থেকে আমরা সাগরে এই দেশি প্রজাতির ধান কৃষকদের মধ্যে চাষের প্রবণতা বাড়ানোর চেষ্টা করলাম। প্রায় পাঁচটি গ্রাম পঞ্চায়েত এলাকায় এখন প্রচুর কৃষক এই ধানগুলির চাষ শুরু করেছেন।’’
দেশি বীজ নিয়ে পরীক্ষানিরীক্ষা করছেন অবসরপ্রাপ্ত প্রাণীবিদ্দের একটি গোষ্ঠী। সাগরদ্বীপের আদি বাসিন্দা অমলেশ মিশ্র জানালেন, ফুলবাড়িতে তাঁরা অন্তত ১০০ প্রজাতির দেশি ধান নিয়ে কাজ করছেন। তাঁর দাবি, ৩০০ কৃষকের মধ্যে সচেতনতা তৈরি করা গিয়েছে। বোটখালিতে কিছু জায়গায় নোনাজল সইতে পারে, এ রকম ‘মালাবতী’ এবং এক জাতের ‘দুধের সর’ ধান নিয়ে পরীক্ষা করছেন তাঁরা।
তবে এ রকম ধানের চাষ কেবলমাত্র কৃষকের নিজের পরিবারের সারা বছর খাওয়ার জন্য, বা অল্প কিছু বাড়তি ধান হলে তা বিক্রির জন্যই কাজে লাগছে। স্বাস্থ্যকর এই সব দেশি ধান থেকে উৎপাদিত চালের বাজার তৈরি করার ক্ষেত্রে সরকারি উদ্যোগ আরও বেশি প্রয়োজন বলে মনে করছেন কৃষকরা। দেশি ধানের চাষ ধীরে ধীরে লাভজনক হলেও, তা সাগর ব্লকের কৃষি আধিকারিকদের নজরে আসছে না বলে আক্ষেপ চাষিদের।
বিঘে প্রতি ধানের ফলন বেশি হলে তা কৃষি দপ্তরের বাৎসরিক রিপোর্টে স্থান পায়। কিন্তু দেশি প্রজাতির ধানের চাষের এসব নমুনা গত কয়েক বছরে সাগরে সংগ্রহ করা হচ্ছে না বলে অভিযোগ। এ ব্যাপারে ব্লকের কৃষি অধিকর্তার বিবেকানন্দ বাগের দাবি, ‘‘ওরা কেরালাসুন্দরী বলে যেটা দাবি করছে, তা কৃষি দফতরের তালিকায় নেই। তাই বিঘে প্রতি ১৬-১৭ মন করে ফলন হলেও সেগুলি সরকারি তালিকায় স্থান পাওয়ার ক্ষেত্রে কিছু বিধিনিয়মের সমস্যা রয়ে যাচ্ছে।’’
আইলার পর থেকেই সাগরে এরকম নানা রকমের ধান চাষ নিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা শুরু হয়েছিল। এ বছর থেকেই রাষ্ট্রীয় কৃষি বিকাশ যোজনায় দেশি ধান উৎপাদনের সরকারি প্রকল্পও হাতে নেওয়া হয়েছে। কৃষি প্রশিক্ষণ কেন্দ্রের যুগ্ম অধিকর্তা অনুপম মন্ডল বলেন, ‘‘আগে কৃষক দেশি চাল উৎপাদন ও খাওয়া অভ্যাস করলে তা ধীর ধীরে বাজারে আসবে। দেশি ধান মানেই যে কম ফলন, এই ধারণা থেকে বের হওয়া বেশি জরুরি।
** নামের পদবী ভূল আছে -অনুপম মন্ডলের জায়গায় অনুপম পাল হবে।
’’